বিয়ের চার বছর হয়েছে এখনো মা হতে পারিনি।
পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছিলো আমাদের।প্রথম প্রথম আমি আর তুষার খুব সুখের সময় কাটিয়েছি। শশুড় শাশুড়ীও খুব আদর করতো আমাকে নিজের মেয়ের মতই ভালবাসে। দুই ননদের তো আমার সাথে খুব ভাব।

কিন্তু গত ছয় মাস ধরে শশুড় শাশুড়ী ননদেরা উঠে পরে লেগেছে কেন আমার বাচ্চা হয়না।তুষারও এতোদিন বাচ্চা না হওয়ায় তেমন কিছুই বলতো না, কিন্তু আজকাল তুষারও ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে বলে চার বছর কেটে গেলো এখনো কেন বাচ্চা হয় না, ওর মা বাবা নাতির মুখ দেখতে চায়।

গতকাল রাতে শাশুড়ী এসে বললো আর কত দিন অপেক্ষা করবো, বাড়িতে একটা বাচ্চাও নেই, বাচ্চা টাচ্ছা ছাড়া কি বাড়ি ভাল লাগে, নাকি শান্তি লাগে, পাশের বাড়ির শেফালির ছেলেকে তুষারের এক বছর পরে বিয়ে দিয়েছে, ছয় মাস হয়েছে বাচ্চা হয়েছে আর আমার ছেলের বৌয়ের ঘরে এখনো কোন বাচ্চা হলো না, আমরা কি ঠাকুমা দাদু হবো না…?

আরো অনেক গুলো কথা শুনিয়ে গেলো, বাচ্চা না হলে আমি কি করবো, আমি ও তো চাই আমার একটা সন্তান হোক, যে আমাকে মা মা বলে ডাকবে।

ননদ রিমি এসে বলল, বৌদি এক কাজ করলে কেমন হয় তোমরা বরং ডাক্তারের কাছে যাও, গিয়ে দেখো কারো কোন সমস্যা আছে কিনা।

রাতে তুষারকে রিমি কথাটা বলতেই তুষার বলল ও কোন ডাক্তারের কাছে যাবে না, পারবে না যেতে, অফিসে কাজের অনেক চাপ। অনেক জোরাজুরি করে তুষারকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম, দুজনেই পরীক্ষা করালাম। যত রকমের টেষ্ট আছে সব গুলোই টেষ্টই করলাম। ডাক্তার বললেন রিপোর্ট আসতে দেরি হবে, দুজনেই অপেক্ষা করছি আর মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকছি, যেনো কোন দুর্সংবাদ না শুনতে হয়। আধ ঘন্টা পরেই তুষারের মোবাইলে ফোন আসলো তাড়াতাড়ি অফিসে যাওয়া জন্য, আর্জেন্ট মিটিং আছে। তুষার আমাকে বলল, খুশি তুমি রিপোর্ট দেখে ডাক্তারের সাথে কথা বলে বাড়ি চলে যেও, আমাকে এক্ষুনি অফিসে যেতে হবে, বস ডাকছেন। আমি বাড়িতে এসে রিপোর্ট দেখবো, বলেই হনহন করে হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে গেলো।

আমার হাতে ডাক্তারের দেওয়া রিপোর্ট আর সেই রিপোর্টে কিছু কঠিন সত্যি কথা লেখা আছে, যা মেনে নিতে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। বাড়িতে আসবার পর থেকে শ্বশুর শাশুড়ী ননদেরা বার বার জিজ্ঞেস করছে রিপোর্টে কি আসছে ডাক্তার কি বলেছে। চোখের জলের জন্য কথা বলতে পারছি না, ওদেরকে কি উত্তর দেবো। শাশুড়ী কঠিন সুরে বলল কি ব্যাপার বলছো না কেন কি হয়েছে।

বললাম ডাক্তার বলেছে সমস্যা টা আমার আমি কোনদিন মা হতে পারবো না, সেই ক্ষমতা নাকি আমার নেই।

কথা টা বলার সাথে সবাই কেমন করে জেনো আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। শাশুড়ীতো রীতিমতো কান্নাকাটি শুরু করে দিলো, আমার ছেলে এই জন্মে কি আর সন্তানের মুখ দেখবে না, আমাদের বংশ কি এখানে শেষ হয়ে যাবে, কি কুলাঙ্গার অপয়া মেয়ে এনে সংসারে ঢুকিয়েছে মা হতে পারবে না, শাশুড়ীর সাথে শ্বশুরও সুর মিলিয়ে বকে যাচ্ছে। ননদেরাও যা তা বলছে একটা বন্ধ্যা মেয়ে আমার ভাইয়ের কপালে জুটেছে।
রাতে তুষার বাড়িতে এলে সবাই মিলে ওকে বোঝালো যাতে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়।আমাকে দিয়ে আর সংসার করা হবেনা।

ফল বিহীন গাছ রেখে লাভ কি, উপরে ফেলে দিয়ে সেখানে নতুন গাছ লাগাতে চাই, আরো অনেক কথাই বলে যাচ্ছে। আমি শুধু দেখছি তুষার কি বলে, কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙ্গে তুষার বলল তোমরা যা ইচ্ছে তাই করো আমার আর এইসব ভাল লাগে না।

রাতে তুষার আমার সাথে একটা কথাও বলেনি, সারাটা রাত কেঁদে বুক ভাসিয়েছি আর ভাবছি চেনা মানুষগুলো এতো তাড়াতাড়িই অচেনা হয়ে গেলো, আমি এখন ওদের কাছে হয়ে গেলাম অপয়া বন্ধ্যা।

সকালে আমাকে ডাকা হলো শ্বশুরের ঘরে, ডেকে নিয়ে বলল তুষারকে যেন ছেড়ে দি, ওরা তুষারকে আবার বিয়ে দিবে, ওদের বংশের প্রদীপ চাই , আর সেটা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না, তাই আমি যেনো ডিভোর্সের ব্যপারটা মেনে নিয়ে তুষারকে চিরদিনের জন্য মুক্ত করে দিই।তুষারের ও নাকি তাইই মত।

তুষারের দিকে তাকাতেই ও বলল মা বাবা যা বলবে তাই হবে, তুমি এটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি কোরো না খুশি প্লিজ, আর কোন টেনশন আমি আর নিতে পারছি না

ভাবতেই কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে কি করে মানুষ এতোটা বদলে যায়। আজ আমি সন্তান দিতে পারবো না বলে আমাকে ওরা তাড়িয়ে দিচ্ছে, কতোটা স্বার্থপর মানুষ।

দুই দিন হয়ে গেলো কেউ আমার সাথে তেমন একটা কথা বলে না, সবাই এড়িয়ে এড়িয়ে চলে।খাবারের সময়ও কেউ ডাকে না। সন্ধ্যার পর শ্বশুর শাশুড়ী এসে বলল তুমি কবে আমার ছেলেকে মুক্তি দিচ্ছো বলো, আমি তুষারের জন্য অন্য মেয়ে পছন্দ করেছি।

মেয়ে পছন্দ করেছেন মানে?

হ্যা করেছি তো আমার ছোট বোনের মেয়ে রেশমির সাথে আমি তুষারের বিয়ে দেবো। এখন তুমি বলো তুমি কখন চলে যাচ্ছো। আর আমি তুষারের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলেছি ওর কোন আপত্তি নেই, তোমার কাছে আমি আমার ছেলের একটা সুন্দর স্বাভাবিক জীবন চাইছি, আশা করি তুমি এটা নিয়ে কোন রকম ঝামেলা করবে না।তুষারের দিকে তাকায়ে দেখি ও ওর মায়ের কথায় সায় দিচ্ছে, আমার সাথে সংসার করতে চাইছে না।

সবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম ঠিক আছে, তাড়িয়ে দিতে চাইছেন চলে যাব, তবে এখন নয় যেদিন তুষারের বিয়ে হবে সেদিনই সবাইকে মুক্ত করে চলে যাব, আর ফিরবো না, কখনো জ্বালাতে আসবো না। তুষার আমার দিকে তাকিয়ে বলল সত্যি তো? হ্যা সত্যি চলে যাব।

আজ তুষারের বিয়ে, মহা ধুমধামে না হলেও বেশ আয়োজনই করেছে, একটু আগে তুষারকে দেখলাম শেরোয়ানি পড়ছে, আমিও বেশ সেজেছি, আমার স্বামীর বিয়ে বলে কথা সেই সাথে আজ যে ওর মুক্তির দিন আর নতুন খুশির দিন। তুষার বরযাত্রীসহ বের হবে আমিও ব্যাগ এ কাপড় গুছিয়ে চলে যাচ্ছি এমন সময় দেখি তুষার বর বেশে সেজেগুজে রেডি হয়ে আছে, খুব হাসিখুশি লাগছে, ওকে ছেড়ে যেতে মন টা মানছিলো না, তবুও যে যেতে হবে। যাবার আগে একবার দুচোখ ভরে তুষারকে দেখে নিলাম, তুষার আমার থেকে মুখটা ফিরিয়ে নিলো।তুষারের কাছে গিয়ে বললাম, তোমার নতুন জীবন অনেক সুখের হোক, বিয়েতে তোমাকে দেবার মত আমার কাছে কিছুই নেই, তবে এই ছোট্ট একটা উপহার তোমার জন্য, নাও। কাগজ টা তুষারের হাতে দিয়ে সবার সামনে দিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম, কেউ আটকালো না। চোখ দুটো বাধ মানছে না অশ্রু অঝরে পড়েই যাচ্ছে।

খুশি চলে যাওয়ার পর তুষার ওর দেওয়া উপহারের কাগজটা খুলে যা দেখলো তাতে ওর সারা শরীর কাঁপছে, চোখ দিয়ে জল পড়ছে। ঘরের সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে তুষারের মুখের দিকে, কি হয়েছে জানার জন্য। কাগজটা পড়ার পর তুষার দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লো, শরীরটা যেনো অবশ নিথর দেহের মত লাগছে।কাগজটা অার কিছু নয়, এটা সেই রিপোর্ট যেটাতে লেখা আছে বন্ধ্যা খুশি নয় বন্ধ্যা তুষার, ওই দিন ডাক্তারের রিপোর্টে রেজাল্ট এসেছিলো তুষার কোন দিন বাবা হতে পারবে না, সেই ক্ষমতা তার নেই, আর খুশি সম্পূর্ণ সুস্থ ওর কোন শারীরিক অক্ষমতা নেই।

রিপোর্টের ভিতরে খুশির একটা চিঠি আছে তাতে লেখা আছেঃ

তুষার,
আমি চাইলেই প্রথম দিনই সত্যিটা বলতে পারতাম, আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম রিপোর্টে আমার দোষ আছে জানলে তুমি কি বলো, তুমি যদি একবার আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলতে তুমি আমাকে ভালবাসো সন্তান না হওয়ায় তোমার কোন আক্ষেপ নেই, আমার কপাল ছুয়ে একটু শান্তনা দিতে তাহলে আমি সারা জীবন তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে জীবনটা পার করে দিতাম, সন্তান সুখ বিসর্জন দিতাম, কিন্তু তুমি তা করো নি, তুমি আমাকে ত্যাগ করেছো, তোমার থেকে আলাদা করেছো, ছিঁড়ে ফেলেছো ভালবাসার বন্ধন। রিপোর্টের ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলে তোমাকে পরীক্ষা করতে চাইনি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম তুমি আমাকে কতটা ভালাবাসো।তুমি হেরে গেছো।
চলে যাচ্ছি পৃথিবীর যেখানেই থাকি প্রার্থনা করি তুমি ভাল থেকো, সুখী হও।

সংগৃহীত।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s